নিজস্ব প্রতিবেদক
বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অবৈধ অর্থ বিনিয়োগের কারণে অস্বাভাবিক ফুলে ফেঁপে ওঠা কানাডার আবাসন খাত দেশটির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। মুদ্রা পাচার, কর ফাঁকি, মাদক চোরাচালান, ঘুষ বা দুর্নীতি এবং আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের টাকা অবাধে এ খাতে বিনিয়োগের কারণে বাড়ী কেনা এখন অসংখ্য কানাডিয়ান নাগরিকের সামর্থ্যের বাইরে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিনিয়োগের নিরাপদ জায়গা হিসেবে কানাডার সুনাম বহির্বিশ্বে এখন সর্বজনবিদিত। এ কারণে দেশটিকে উচ্চ মূল্য দিতে হতে পারে এবং সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যে এর মূল্য দিতে শুরু করেছে। এ বিষয়ে অবহিত থাকলেও কোন ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে এখনো দেয়া হয়নি। তবে অর্থমন্ত্রী বিল মরন্যু বলেছেন, বিষয়টিতে নজর রাখা হচ্ছে।
আর্থিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কানাডা শাখার সাবেক সভাপতি পিটার ডেন্ট বলেন, “আমরা কেউ জানি না দেশের প্রধান শহরগুলোতে আবাসন খাত এভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠার পরিণতি কি। সাধারণ মানুষ বাড়ী কিনতে চাইলেও বর্তমান পরিস্থিতি তাদের সামর্থ্যের মধ্যে নেই। অর্থ বা সম্পদ লুকিয়ে রাখতে চান এমন ব্যক্তিদের জন্য কানাডা এখন অত্যন্ত আকর্ষণীয় জায়গা।“
তিনি বলেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা সনাক্ত করার বিষয়টিকে ব্যক্তির গোপনীয় তথ্য হিসেবে আইনে স্বীকৃতি দেয়ার কারণে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে লুকিয়ে রাখার অন্যতম নিরাপদ স্থান এটি। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা আর্থিক লেনদেন তদন্ত করতে ব্যর্থ হয় কেননা তাঁরা এসব প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মালিকদের সনাক্ত করতে পারে না। গত কয়েক বছরে ভ্যানকুবারে অত্যন্ত বিলাসবহুল কিছু বাড়ীর ক্রেতা এবং বিক্রেতাদের চিহ্নিত করা যায়নি বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কানাডা সম্প্রতি পরিচালিত এক অনুসন্ধানে উল্লেখ করে বলেছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন অথবা ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে তাদের নাম গোপন রাখা হয়েছে।
অর্থনৈতিক অপরাধের মূল অস্ত্রই হচ্ছে গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং কানাডার আইনে ভালোভাবেই এর স্বীকৃতি দেয়া আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে অর্থমন্ত্রী বিল মরন্যু এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “কে এবং কি উদ্দশ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করছে, এদেশের নিয়ম মেনে আয়কর দিচ্ছে কিনা অথবা অন্য কোথাও কর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে কিনা আমরা অবশ্যই এসব তথ্য জানার পক্ষে।“
আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র তাদের কর্মকাণ্ডে তহবিল যোগাতে কানাডার লাভজনক আবাসন খাতকে অবৈধভাবে ব্যবহার করছে। এ কাজে স্থানীয় নাগরিকদের পাশাপাশি দাতব্য সংস্থা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে গত বছরের মাঝামাঝি উল্লেখ করে ফিনান্সিয়াল একশন টাস্ক ফোর্স। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফেডারেল সরকারকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানায় প্যারিস-ভিত্তিক এ আন্তর্জাতিক সংস্থা।
আবাসন ছাড়াও দাতব্য সংস্থা ও জীবন বীমাকে ঝুঁকিপূর্ণ খাত হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয় এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সন্ত্রাসী চক্র বিনিয়োগ ও আর্থিক লেনদেনের মতো বিষয়গুলো নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারছে, এ কথা উল্লেখ করে সংস্থাটি জানায়, কোম্পানী ও ট্রাস্ট গঠন করে এসব খাতে বিনিয়োগ এবং সার্বিক প্রক্রিয়ায় আইনজীবীদের মুখ্য ভূমিকা পালন দেশটির পক্ষে মুদ্রাপাচার রোধে কার্যকর ভূমিকা নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মক্কেলদের পক্ষে নেয়া আইনজীবীদের কর্মকাণ্ড আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তদন্ত করতে পারে না এবং এ কারণে তাঁদের ওপর নির্ভর করার সুযোগ কম। গোপনীয়তা বিবেচনায় এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেনগুলোতে এক ধরণের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে।
ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিনট্র্যাক এর আগে মুদ্রা পাচার এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তহবিল যোগানোর ক্ষেত্রে বৈধভাবে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জড়িত থাকার প্রমাণ পায়। এছাড়া কানাডা রেভিনিউ এজেন্সীও বিভিন্ন সময়ে দাতব্য সংস্থার ওপর অনুসন্ধান চালিয়ে কয়েকটি ঘটনায় জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছিল।
এদিকে, সরকারী সংস্থা কানাডা মর্টগেজ এবং হাউজিং কর্পোরেশন ২৬ জানুয়ারী প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে আবাসন খাতে অস্বাভাবিক দাম বাড়ার প্রবণতা এখন ব্যয়বহুল ভ্যানকুবার ও টরন্টো থেকে আশেপাশের শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেছে।
অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে ১৫টি শহরে অনেক বেশী বাড়ী তৈরি হচ্ছে যার সাথে জনসংখ্যা ও মানুষের আয় বাড়ার সামঞ্জস্যতা নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাড়ীর ক্রেতাদের বিচক্ষণ হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ভবিষ্যত বাজার অবস্থা এবং নিজেদের প্রয়োজন বিবেচনা করে বাড়ী কেনার সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে।
আবাসন খাতের বর্তমান পরিস্থিতিকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অভিহিত করে প্রথমবারের মতো সরকারের পক্ষ থেকে গত অক্টোবরে সতর্কতামূলক লাল সংকেত জারী করে এ খাতে ফটকাবাজি চলছে বলে উল্লেখ করে সংস্থাটি।