বিশেষ প্রতিবেদন
নোভা স্কশিয়াতে বেড়ে ওঠা মাইরোন গ্যারন প্রতিষ্ঠিত হতে চলে আসেন টরন্টোতে। যোগ দেন নোভা স্কশিয়া ব্যাংকে। সেখানে পরিচয় সহকর্মী বার্নার সাথে। পরিচয় থেকে ঘনিষ্টতা। এক পর্যায়ে দু’জনে শুরু করেন সংসার। টরন্টো ইস্ট জেনারেল হাসপাতালে ১৯৬২ সালে জন্ম নেয় তাঁদের প্রথম সন্তান -- মাইকেল। কিন্তু দুর্ভাগ্য -- মাত্র তিন বছর বয়সে শিশু মাইকেলের হাতে দেখা দেয় সমস্যা।
শিশুদের জন্য বিশেষ হাসপাতাল সিক কিডসে শুরু হয় তার চিকিৎসা। তাকে সুস্থ করতে একের পর এক চেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু মাইকেল সুস্থ হয় না। তার হাতের কব্জির সমস্যা জটিল হতে থাকে। চিকিৎসকেরা প্রথম দিকে তার সমস্যা বুঝতে পারেননি। ছয় বছর বয়সে ধরা পড়ে বিরল সফ্ট টিস্যু ক্যান্সার। শুরু হয় কঠিন এক যুদ্ধ। মাইকেলের মা বার্না বলেন, সে ছিল খুব প্রতিভাবান -- সৃজনশীল হাত ছিল তার। ছোট থাকতেই অনেক কিছু তৈরী করতে পারতো সে। এক সময় মাইকেল জানতে পারলো, সময় শেষ হয়ে আসছে। নিজের সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরী হয়ে গিয়েছিলো তার।
একটা জাহাজের সাথে নিজেকে তুলনা করে সে বলতো, জাহাজটার মূল কাঠামোতে বড় একটা ভাঙ্গন ধরেছে এবং সেটা খুব দ্রুত ভেঙে পড়ছে। মায়ের কাছে তার আশংকার কথা জানিয়ে মাইকেল বললো, “আমার ভয় হয়, মানুষ আমাকে ভুলে যাবে। অসহায় মা সন্তানকে এই বলে সান্ত্বনা দিলেন যে, “এটা কখনোই ঘটবে না। যতক্ষণ আমরা বেঁচে থাকবো, কখনোই তোমাকে ভোলা সম্ভব নয়।“ অবশেষে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দীর্ঘ যুদ্ধে হার মানলো মাইকেল। বিদায় নিলো, সবাইকে শোকে ভাসিয়ে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ছেলেকে দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি বারবার ঘুরে ফিরেছে বাবা গ্যারন এবং মা বার্নার মনে। মাইরোন গ্যারন তিন দশক ধরে গড়ে তোলেন একটা গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা।
বাণিজ্যিকভাবে সফল কারখানাটা তিনি বিক্রি করে দেন ২০০০ সালে। গ্যারন বলেন, কারো প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা থাকলে তিনি ভাগ্যবান। তবে সে টাকা ভালো কাজে ব্যয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাইকেলের মতো অন্য শিশুদেরকে যেন কষ্ট পেতে না হয় সেজন্য সব ধরণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। মাইকেল ১৯৭৫ সালে বিদায় নেয়ার আগ পর্যন্ত টরন্টোতে শিশু হাসপাতাল সিক-কিডসেই চলে তার দীর্ঘ চিকিৎসা। এ হাসপাতালের উন্নয়নে দিয়েছেন ৩০ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া আরো দুটো হাসপাতালে দিয়েছেন ২০ মিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন হাসপাতালের উন্নয়নে ব্যয় করেছেন ১১০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ।
গ্যারন পরিবারের জন্য ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন, ছেলেকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনের দিন। বিদায়কালে সন্তানকে দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি মা রাখতে পেরেছেন দীর্ঘ ৪০ বছর পর। মায়ের সেই প্রতিশ্রুতি এখন ইতিহাসের অংশ। যেখানে মাইকেলের জন্ম হয়েছিল, ড্যানফোর্থের বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকার অদূরে টরন্টো ইস্ট জেনারেল হাসপাতালের উন্নয়নে মাইকেলের বাবা উপহার দিলেন ৫০ মিলিয়ন ডলার। এটা কানাডার কম্যুনিটি হাসপাতালের ইতিহাসে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। আর গ্যারন পরিবারের প্রতি সন্মান জানাতে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো মাইকেল গ্যারন হাসপাতাল।
সীমিত সামর্থ্যের আবর্তে ধুঁকতে থাকা হাসপাতাল যেন গ্যারন পরিবারের মহানুভবতায় নতুন করে জেগে উঠলো। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা, গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং প্রতিভাবান কর্মী আকৃষ্ট করতে কর্তৃপক্ষের নেয়া পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে এ হাসপাতাল হয়ে উঠতে পারে হাজারও অসহায় মানুষের ভরসার জায়গা। এ বিষয়ে বার্না বলেন, “আমাদের ছেলে বিদায় নেবার আগে তার কাছে আমরা একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। তোমার স্মৃতি আমরা কখনোই ভুলতে দেব না। অসংখ্য শিশু এবং তাদের পরিবার চিকিৎসার জন্য এ হাসপাতালে আসে। আমাদের এ উপহার তাদের কাজে আসবে -- এটাই আমাদের সান্ত্বনা।“