রিজওয়ান রহমান
"স্বপ্ন হবে সত্যি, ইটের পর ইট" এমন একটা টিভি এড দেখতাম ছোট বেলায়। সেই কথাটাই আজ খুব মনে পড়ছিলো গোল্ডেন এজ সেন্টারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। কোভিড-এর কারণে খুবই ছোট্ট পরিসরে আয়োজন ছিল, কিন্তু উপস্থিত সবার আবেগ আর উৎসাহ যেন পুরো কমিউনিটির আবেগেরই প্রতিফলন ঘটাচ্ছিলো।
আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে যখন কমিউনিটি ওয়ার্ক-এ হাতে খড়ি হচ্ছিলো, তখন বাংলাদেশ সেন্টারের হাসিনা আপার আহ্বানে ওখানকার ‘সিনিয়র'স কম্পিউটার ক্লাস’ এ শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছিলাম প্রায় এক বছর। প্রতি রোববার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা - এই দুই ঘন্টা কমিউনিটির বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজনকে কম্পিউটারের মৌলিক বিষয়গুলো শেখাতাম। তিন কি চার মাসের কোর্স ছিলো এক একটা।
কম্পিউটারের মৌলিক বিষয় বলতে আসলে ইন্টারনেট ব্রাউসিং, বাংলা পত্রিকা খুঁজে পড়া, ই-মেইল আর ফেসবুক চালানো, ইউটিউবে নাটক, গান, ধর্মীয় ভিডিও ইত্যাদি খুঁজে বের করে দেখা - এইসব। সাথে অংশগ্রহণকারীদের জন্য সামান্য নাশতার ব্যবস্থা থাকতো, সিঙ্গাড়া-আলুর-চপ এইসব। প্রোগ্রামটা সরকারি ফান্ডে চলতো। একসময় ফান্ড বন্ধ হয়ে গেলো। তখন প্রোগ্রামটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু ততদিনে আমি দেখেছি যে, সপ্তাহের ওই একটি ক্লাস-এর জন্য আমার ক্লাসের "ছাত্র ছাত্রীরা" কিভাবে অপেক্ষায় থাকতেন। তাঁদের বেশিরভাগের জন্যই কম্পিউটার শেখাটা একটা বাহানা ছিলো মাত্র। মূল আকর্ষণ ছিলো সপ্তাহের ওই একটা দিন সমবয়সী কয়েকজন একসাথে একটু দেখা হওয়া, গল্প করা, আর এসবের ফাঁকে ফাঁকে ইন্টারনেটে বাংলা পত্রিকা দেখা, গান শোনা আর ফেসবুকে হয়তো হঠাৎ দেশে ফেলে আসা কোনো বন্ধুর একটা আপডেট দেখা। এর মাঝে যে কি আনন্দ! প্রোগ্রামটি যখন ফান্ডের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা, আমি হাসিনা আপাকে বলেছিলাম যে, আমাকে যদি শুধু ওই কম্পিউটার রুমটি ব্যবহার করতে দেন, তাহলে আমি নিজের খরচে নাশতার ব্যবস্থা করে ক্লাসটি চালু রাখতে চাই। আপা সম্মতি দিয়েছিলেন, কিন্তু এরপরও বেশিদিন চালাতে পারিনি কারণ শীত-বর্ষায় এতদূর গিয়ে অনেকেই আর ক্লাসে আসা চালু রাখতে পারেননি। ক্লাস বন্ধ হয়ে গেলো, কিন্তু ওই বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষগুলোর আনন্দমাখা মুখগুলো মনে গাঁথা হয়ে ছিলো।
তাই স্বপ্ন দেখতাম, সৃষ্টিকর্তা উপায় করে দিলে একদিন এইসব বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য চলাচলে সুবিধা হয় এমন একটি জায়গায় একটা সিনিয়র'স ক্লাব করবো, যেখানে তাঁদের জন্য একটু বিনোদন, আনন্দ ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু এমন একটি পদক্ষেপ কারও একার পক্ষে বাস্তবায়ন অসম্ভব। তাই বিষয়টি নিয়ে কমিউনিটির শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গের সাথে যখন আলোচনা করলাম, প্রত্যেকেই উৎসাহ দিলেন, যেভাবে প্রয়োজন সর্বোচ্চ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন। সদস্য সংখ্যায় কমিউনিটির অন্যতম বৃহৎ সামাজিক সংগঠন জালালাবাদ এসোসিয়েশনই হোক, অথবা অল্প সদস্যের কোনো সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন KUET এলামনাই এসোসিয়েশন হোক অথবা কৃষিবিদদের সংগঠন ABACAN, স্থানীয় বাংলা পত্রিকা-টিভির নেতৃবৃন্দ থেকে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সবাই একযোগে উৎসাহ যোগালেন। আর এর ফসলই হচ্ছে আজকের গোল্ডেন এজ (অর্থাৎ স্বর্ণালী সময়) সেন্টার।
বাংলাদেশে আমাদের গুরুজনরা ঘর থেকে বেরিয়ে দু'পা এগুলে অথবা মস্জিদ-মন্দিরে কিংবা পাড়ার চায়ের দোকানে থামলেই তাঁদের সমবয়সীদের সাক্ষাৎ পেতেন। অলস দুপুরে আরাম চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে হয়তো কোনো একটা মাসিক পত্রিকা, বিশেষ সংখ্যা, ধর্মীয় বই, অথবা উপন্যাস তুলে নিয়ে একটু চোখ বুলাতেন। বিকালে পাড়ার দোকানে সমবয়সীদের সাথে বসে চা- বিস্কুট হাতে চলমান নানান বিষয়ে আলোচনায় মত্ত হতেন। কিন্তু আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জীবনের স্বর্ণালী সময়টিতে নিজেদের পরিচিত সবকিছু ছেড়ে এই অচেনা দেশে এসে তাঁরা অনেকটা গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। আমরা যারা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী, তারা নানান ভাবে নিজেদের বন্ধুবলয় তৈরী করে নিয়ে থাকি, বিনোদনের ব্যবস্থাও করি। কিন্তু সাংস্কৃতিক-ভাষাগত নানান কারণে আমাদের গুরুজনদের পক্ষে সেটাও কঠিন। বিশেষ করে এপার্টমেন্ট বা কন্ডো ভবনগুলোতে যাঁরা থাকেন তাঁদের পরিবেশটা আরো বদ্ধ।
বহুদিনের ইচ্ছা, এইসব গুরুজনদের জন্য এমন একটা জায়গা করে দেয়া যেখানে ছোট্ট একটা লাইব্রেরী থাকবে, আরাম করে বসে বই, পত্রিকা, সাময়িকীগুলো পড়ার ব্যবস্থা থাকবে, সমবয়সীদের সাথে ক্যারম-দাবা-লুডু খেলার সুযোগ থাকবে, ইন্টারনেটসহ কম্পিউটার আর বিশাল স্ক্রিন-এর টিভির ব্যবস্থা থাকবে। সাথে থাকবে বিনামূল্যে চা- বিস্কুটের ব্যবস্থা। সেইসাথে থাকবে বিশেষজ্ঞদের পরিচালনায় নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয়ের উপর ছোট-ছোট তথ্যমূলক প্রোগ্রাম। থাকবে সেন্টারের ওপেন আওয়ারে যে কোনো বিপদে অথবা প্রয়োজনে সহায়তা করার জন্য সার্বক্ষণিক একজন ব্যবস্থাপক। যেখানে থাকবে না কোনো প্রোগ্রামের শর্ত পূরণের তাড়া, থাকবে না বাইরের কোন চাপ। যেখানে প্রথম এবং একমাত্র বিষয় হবে গুরুজনদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুযোগসুবিধা।
আনন্দের সাথে জানাতে চাই যে, এই সমস্ত আয়োজন নিয়েই পথচলা শুরু করেছে ‘গোল্ডেন এজ সেন্টার’। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় এই সবকিছুই হবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। গোল্ডেন এজ সেন্টার কোনো সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা নেবে না। শুধু দরকার আপনাদের সবার শুভ কামনা আর অনুপ্রেরণা। শুরুর দিকে সপ্তাহে ৭ দিন, প্রতিদিন দুপুর ১ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ক্লাব এর সুযোগ সুবিধা উপভোগ করতে এর সদস্য হতে হবে। সদস্য ফর্ম ক্লাবের অফিস ডেস্কে পাওয়া যাবে। সেন্টার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে ফেইসবুক পেজ Golden Age Centre-এ চোখ রাখতে অনুরোধ করছি।
আর ঐ যে শুরুতে বলছিলাম "স্বপ্ন হবে সত্যি", ধীরে ধীরে এমন সব স্বপ্নগুলো সত্যি হবে, এই প্রত্যাশা নিয়েই পথচলা। ধন্যবাদ টরন্টোর বাংলা পত্রিকা-টিভিসহ বিভিন্ন মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের, আজ যাঁরা উপস্থিত ছিলেন। ধন্যবাদ আমন্ত্রিত অতিথিদের। আর কোভিড-এর কারণে যাঁদের আজ আমন্ত্রণ জানাতে পারিনি, আপনারাও আমার পরিবারেরই অংশ, আশা করি আগামী কিছুদিনের মধ্যে একবার ক্লাবটি ঘুরে যাবেন, এর ফ্যাসিলিটিজ-গুলো দেখে যাবেন আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, তা হলো পরিচিত সিনিয়রদের আমাদের এই ক্লাবটির কথা জানিয়ে দেবেন যাতে তাঁরা এর সদস্য হয়ে এই আয়োজনের পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন।