(বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের যুদ্ধ ও বিপ্লবের খবর বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিয়ে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছানো ব্রিটিশ সাংবাদিক, বাংলাদেশের বন্ধু সায়মন ড্রিং ৭৬ বছর বয়সে মারা গেছেন। তার জীবনসঙ্গী ফিওনা ম্যাকফারসন ফেইসবুক নোটে স্মরণ করেছেন সায়মনের জীবন, কাজ এবং তাদের ২৬ বছর একসঙ্গে পথচলার কথা।)
স্মরণে তুমি
বুক ভাঙা কষ্ট নিয়ে আমাকে জানাতে হচ্ছে আমার ২৬ বছরের জীবনসঙ্গী, আমাদের জমজ সন্তানদের বাবা সায়মন ড্রিংয়ের আকস্মিক আর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর খবর। একটি রুটিন, কিন্তু জরুরি অস্ত্রোপচার শেষে রোমানিয়ার এক হাসপতালে চিকিৎসাধীন ছিল সায়মন। কিন্তু তার মধ্যেই শুক্রবার, ১৬ জুলাই ২০২১, রাত আড়াইটায় ও চলে গেল। আমরা রোমানিয়ায় আছি ২০২০ সালের শুরু থেকে। পুরোপুরি অবসর জীবন কাটাতে শিগগিরই ফ্রান্সে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। সেজন্য দারুণ খুশি ছিলাম, ভাবছিলাম, এবার পুরো সময়টা পরিবারের জন্য দিতে পারব, সায়মন ওর আত্মজীবনী লেখার কাজে হাত দিতে পারবে।
একজন প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাংবাদিক হিসেবে সায়মনের সাফল্য আর অর্জনের কথা সবাই জানে। তার অকপট প্রকাশ, যে কোনো মূল্যে সত্য ঘটনা তুলে আনার চেষ্টা, সেজন্য যেখানে দরকার সেখানেই যাওয়া, এবং শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে যা কিছু করা দরকার, তা করা- এসব এখন কিংবদন্তি।
আমাদের যমজ মেয়েরা বহু রাত ঘুমাতে যাওয়ার সময় কিংবা গোসলের সময়টায় তাদের বাবার অসাধারণ সব অভিযানের গল্প শুনে কাটিয়েছে! সেসব গল্প আমাদের মেয়েদের, এবং আমাকেও সীমাহীন উৎসাহ আর সাহস যুগিয়ে গেছে জীবনের পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য, জীবনের অর্থ আর অজানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার জন্য। একজন বিদেশি সংবাদদাতা হিসেবে বহু বছরের কাজের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেছিল সায়মন, ইচ্ছে ছিল, ভবিষ্যতে কোনো এক দিন দক্ষিণ এশিয়ায় সেগুলো প্রকাশ করা হবে।
সায়মনের প্রিয় বাংলাদেশ এবার স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক উদযাপন করছে। সেজন্য এ বছরের শেষ দিকে সর্বশেষ একটি কাজে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল ওর। ইতিহাসের একটি পর্ব, যার ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে বাস্তবিক আর আত্মিকভাবে চিরতরে জড়িয়ে গেছে সায়মন, তার জন্য এমন একটি মাইলফলকে উপস্থিত থাকতে না পারাটা খুব কষ্টের হত। এখানে বলে রাখি, হাসপাতাল থেকে ওরা আমাকে বলেছে, মৃত্যুর সময় সায়মনের গায়ে ছিল তার ইটিভির পোলো শার্ট, সেটা এখন আমাদের মেয়েদের কাছে তাদের বাবার একটি অতিমূল্যবান স্মৃতিচিহ্ন।
আমার এই ভারাক্রান্ত মনে আজ অনেক স্মৃতির ভিড়, অনেক কথাই আজ বলতে ইচ্ছা করছে। স্বাভাবিক জীবনে একটা মানুষ সাধারণভাবে যা চায়, রুটিন বিষয়গুলো, দায়িত্ব পালন, ধারাবাহিকতা, নিরাপত্তা, কিংবা মূলধারায় থাকা- তার কোনোটাই কখনো পূরণ হয়নি সায়মনের যাপিত জীবনে। সেরকম জীবন যাপন করা তার জন্য ছিল এক কথায় অসম্ভব। তার জীবন ছিল আইকনিকভাবে অনন্য।
সায়মনের কাছের বন্ধু ও স্বজনদের অনেককে আমি এখনও এই শোকের খবরটি জানিয়ে উঠতে পারিনি, আমার অপারগতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। যা ঘটেছে, তা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সায়মনের সুহৃদ আর সহকর্মীদের প্রতি বলছি; আপনাদের অনেকেই ওর অনন্য ইতিহাসের অংশীদার। আমি বলতে চাই, ওর জীবনের আখ্যান রূপায়নে বরাবরই আপনারা অংশীদার ছিলেন, এখনও দারুণভাবেই আছেন। বহু বছর ধরে আপনারা আমাদের অনেক ভাবনা আর আলাপচারিতার অংশ হয়ে আছেন। টিম পেইজ। ফরহাদ মাহমুদ। বারনার্ড। আবু আলম। এমা। ঝর্না। দেবেন। এবং আরও অনেকে।
বন্ধু, স্বজন আর সহকর্মীরা যারা সহানুভূতি জানিয়ে বার্তা পাঠিয়ে চলেছেন, আপনারা জানবেন, আপনাদের বার্তা আমাকে আন্তরিক স্বস্তি দিচ্ছে। আমি এবং আমার ছোট্ট দুটি মেয়ে আপনাদের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আমরা যতটা পারি প্রত্যুত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেনে সায়মনের পরিবারের সদস্যরা, যারা বহু বছর ধরে তাকে ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে গেছেন; তাকে মিস করেছেন; আরও একটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তার বাড়িতে ফেরার জন্য অপেক্ষায় থেকেছেন, এবং শঙ্কায় থেকেছেন আদৌ সে ফিরবে কি না, আমি জানি, ও আপনাদের প্রতি আন্তরিকভাবেই কৃতজ্ঞ ছিল, আমি জানি, এ নিয়ে ওর অনুতাপও ছিল। প্রথম সংসারে সায়মনের প্রিয় মেয়ে তানিয়া; আর তার প্রথম স্ত্রী হেলেন, যিনি তাকে প্রথমে এই উচ্চতায় পৌঁছাতে সমর্থন যুগিয়ে গেছেন, সায়মনের বোন সু, যিনি পাশে ছিলেন নিরন্তর, সায়মন যখন দূরের কোনো দেশ থেকে উড়ে এসে বিমানের দরজা দিয়ে বেরুতো একবেলা খাবার আর পরিবারের উষ্ণতার প্রত্যাশা নিয়ে, সু সব সময় ছিলেন তার জন্য। আমি অন্তর থেকে তোমাদের ধন্যবাদ জানাই। সায়মন তার হৃদয় উজাড় করে তোমাদের ভালোবাসত।
টম, ড্যান, মিশেল, সোফি, ক্রিস, জেরেমি এবং সব ভাগ্নে-ভাগ্নি, চাচাতো-মামাতো-খালাতো-ফুফাতো ভাই-বোন ও তাদের পরের প্রজন্মের সবার প্রতি গভীর অনুরাগ অনুভব করত সায়মন। তোমাদের সবাইকে নিয়ে ও গর্ববোধ করত। হয়ত তার সেই অনুভূতির প্রকাশ হত একেবারেই সায়মন ড্রিংয়ের নিজস্ব ভঙ্গিতে। ওর নাতি নিকোলাস ও জেমস, তোমরা যেভাবে আত্মবিশ্বাসী, সুপুরুষ তরুণ হয়ে বেড়ে উঠছ, তা দেখে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত ওর মুখ, আমি তার সাক্ষী।
একটি জীবন। অনেক ভাগ, অনেক অধ্যায়। অন্য অনেকের চেয়ে সায়মনের জীবনে তা হয়তো আরও বেশি। এর সবটুকু জুড়ে আছে তার পরিবার, তার বন্ধুরা, তার মা-বাবা, ফেইকেনহ্যাম, ইংল্যান্ড, ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ, রোমানিয়া, হাইতি, সিল্ক রোড, ইরিত্রিয়া, অন দ্য রোড এগেইন, বিবিসি, রয়টার্স, দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, স্পোর্টএইড, ভারত, লাওস, ইরান, ইটিভি, যমুনা টিভি, সব টিভি, রোমানিয়ার এতিমখানা আর পথশিশু, যারা তাকে তাদের বাবার মত ভালোবাসত, এবং তার ১০ বছরের অসাধারণ যমজ মেয়েরা: সবই, সবাই তার জীবনের সঙ্গেই এগিয়েছে, তার অনন্য জীবনের অংশীদার হয়েছে। সে জীবন যাপিত হয়েছে দারুণভাবে, তার নিজস্ব মূর্ছনায়।
তার অবদান, তার উত্তরাধিকার আগামীতেও বহমান থাকবে নিজস্বতার জোরেই; আমরা তা মলিন হতে দেব না। তোমার তিনটি গোলাপ ভেঙে পড়েছে, ড্রিংগো।
আজ ইনডিয়া আর আভা যখন তোমার শীতল শবদেহ জড়িয়ে ধরল; তোমার কানে কানে তাদের প্রতিশ্রুতি শোনালো এবং তোমার অসাধারণ শান্ত মুখে চুমু খেল- আমি ভাবছিলাম, কীভাবে সম্ভব এরপর সামনে এগিয়ে চলা।
যেদিন সকালে তুমি মারা গেলে, যখন আমি তোমায় জড়িয়ে ধরে ছিলাম প্রবল অবিশ্বাস নিয়ে, তোমার কাছে আমার নিজের প্রতিজ্ঞা, আমাদের চমৎকার মেয়ে ইনডিয়া আর আভাকে আমি দৃঢ়, সমর্থ্য, দক্ষ, সাহসী, কর্মতৎপর নারী হিসেবে গড়ে তুলব; যারা হবে সৃষ্টিশীল, দয়ালু, যারা ঘুরে বেড়াবে দুনিয়াজুড়ে, তাদের উৎসাহ থাকবে সীমাহীন, দিগন্ত হবে বিস্তৃত। তুমি তাদের কতোটা আদর করতে সে তো আমি জানি।
তুমি ছিলে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আমার আত্মার আত্মীয়। তোমার ভালোবাসা, আর একসঙ্গে কাটানো দিনগুলোর জন্য আমি যে ঋণী। ওহ ড্রিংগো, আমরা সবসময় ভেবেছি, তুমি চিরদিনই থাকবে। কখনো ভুলবো না তোমায়। চির শান্তির হোক তোমার এই ঘুম। এখন সেই সময়।
(সায়মন জন ড্রিং: ১১ জানুয়ারি ১৯৪৫-১৬ জুলাই ২০২১/অনুবাদ:বিডিনিউজ২৪)