সালাহ উদ্দিন শৈবাল
সকালে অফিস টাইমে বাসে, সাবওয়েতে ভীড় থাকে। পৃথিবীর সব শহরেই থাকে। টরন্টোতে শীতকালে সাবওয়েতে আরো বেশি থাকে। রাস্তাঘাটে স্নো থাকে। বাইরে ঠান্ডা থাকে। লোকজন নিজের গাড়ী কম নেয়। সাবওয়ে মাটির নিচ দিয়ে চলে। তাই ক্ষানিকটা নিরাপদ আর সহনীয়।
আমিসহ অনেক মানুষ ভীড় করে ষ্টেশনে দাড়িয়ে ছিলাম। আমার ঠিক সামনে এক মহিলা। চল্লিশ-টল্লিশ হবে। সংগে একটা বাচ্চা ছেলে। বয়স ছয়-সাত। একেবারে জ্যাকেট পরিয়ে প্যাকেট করে এনেছে। উপায় বা কি? এবার যা ঠান্ডা পড়েছে! সাবওয়ে চলে এলো। হুড়মুড় করে সব মানুষ এক সংগে এগিয়ে এলো। অফিস টাইম। সবার অসভ্য রকমের তাড়া। মহিলা তার বাচ্চা নিয়ে উঠতে পারলো। অনেক কষ্ট হলো। আশে পাশের প্রায় সবাই মহিলা আর বাচ্চাকে টপকে আগে আগে ঢুকে গেছে। ভেতরে তখনো একটা সীট খালি ছিলো। মহিলা বাচ্চাটাকে বসতে দিল। একটু সময় নিলো। সাবওয়ে চলা শুরু করেছে। তারপর খুব পরিষ্কার গলায়...সবাই যেন শুনতে পায় এভাবে বাচ্চার সংগে কথা বলা শুরু করলো-
“জুনিয়র…তুমি এখন ছোট। এই মাত্র যা ঘটলো...তুমি জানো এটা প্রতিদিন ঘটে। আমি তোমাকে নিয়ে দাড়িয়ে থাকি। সাবওয়ের জন্য অপেক্ষা করি। সাবওয়ে এলেই...সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারা একটা বাচ্চা আর তার মাকে ধাক্কা দিয়ে আগে আগে ঢুকে যায়। এটা...তুমি যখন বড় হবে তখন কক্ষনো করবে না। কক্ষনো না। এটা ঠিক না। কোনদিন না...কোন সময় না..কোনভাবেই না। আমি জানি...প্রতিদিন এটা ঘটে। প্রতিদিন আমি তোমাকে এটা স্মরণ করিয়ে দেই। আমিও ক্লান্ত হই। একই কথা বলতে বলতে....একই অন্যায় দেখতে দেখতে...আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। কিন্তু মা হিসাবে আমার কাজ তোমাকে ভালো-মন্দ...ঠিক-বেঠিক শেখানো। আমি যেমন আমার শরীর খুব খারাপ হলেও তোমার ক্ষিদে লাগলে..তোমাকে খাবার দেয়া আমার দায়িত্ব মনে করি...........ঠিক তেমনি তোমার সামনে অন্যায় কিছু ঘটলে…ভুল কিছু ঘটলে…সেটা সংগে সংগে বলে দেয়াও আমার দায়িত্ব মনে করি। এই জন্যই আমি তোমার মা।“
সাবওয়েতে এমনি লোকজন চুপচাপ থাকে। মহিলার স্পষ্ট আর ঠান্ডা গলায় পুরো কম্পার্টমেন্ট ঠান্ডা হয়ে গেল। মহিলা স্থির গলায় আস্তে ধীরে তার বাক্যালাপ চালিয়ে গেলো। পুরো কম্পার্টমেন্ট তা শুনলো। জুনিয়র মায়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। আমি মাথা নিচু করে ভাবতে বসলাম। ঠিক কবে থেকে আমি এভাবে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছি? সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলা ছেড়ে দিয়েছি? আগে পারতাম। মনে হতো এটাইতো ঠিক। যখন ছোট ছিলাম। যখন বোকা ছিলাম। নিজের ভালো মন্দ বুঝতাম না। ঠিক ঠিক...ঠিক কথাটা বলে দিতে পারতাম।
এখন বড় হয়েছি। সংসারী হয়েছি। এখন পারি না। বলি না। বলতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়...বলে কি হবে....বলে বলে কবে কি পাল্টেছে। মেনে নিতে শিখেছি। মানিয়ে নিতে শিখেছি। আমার সামনে বসে মাস-কাবারী মাঝারী চাকরী করা কোন আত্মীয় তার তিনটা ফ্ল্যাট আর তার ভেতরে জমকালো ইন্টিটেরিয়রের গল্প করলেও আমি হাসি মুখে শুনতে পারি। আগ্রহ নিয়ে তার ছবি দেখি। আমি এখন পারি।
নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ ফেলে দেওয়া কোন পরিচিত জন যখন তার অসম্ভব মেধাবী ছেলেকে...যে হয়তো ভালো রির্সাচার হতে পারতো...তাকে বিসিএস ‘কাষ্টম্স’এ দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যায়....তখন আমিও তাতে তাল দিতে পারি। অফিসের সবচেয়ে মিস-ফিট কর্মী রেহানা আপা। যার কাজই হচ্ছে অফিসের বসদের বাসায় দাওয়াত করে করে খাওয়ানো। জামা-পায়জামা গিফ্ট করা। এভাবে একটা প্রমোশনও হয়ে গেছে। তার বাড়ীতে আমিও মিষ্টির প্যাকেট হাতে হাসি মুখে দাওয়াত খেতে চলে যেতে পারি। তাকে কন্গ্র্যাচুলেট করতে পারি।
জীবনে কোথাও কোনদিন কোন কর্মক্ষেত্রে একটাও বড় প্রজেক্ট লীড করেনি....একটাও লাভজনক ভেঞ্চার গড়ে তোলেনি...১০০ জনের সংগে হাঁটেনি...জীবনে ন্যুনতম ১০টা বছর চড়াই-উৎরাই দেখেনি.....আমি এখন গম্ভীর মুখে তাদের ‘ক্যারিয়ারে সফল হওয়ার উপায়’ নিয়ে ‘মোটিভেশনাল’ বক্তব্যও শুনতে পারি। তাদের হাতে হাত রেখে...”কি যে বললেন ভাই!!” বলতে পারি। সামাজিক আর আপটুডেট থাকার জন্য সস্তা আর ভালগার ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ‘ফান’ করতে দেখে আমার আর এখন খারাপ লাগে না।
গাড়ীর ফিটনেস করাবে ঘুষ দিয়ে, ডাক্তারের এপয়ন্টমেন্ট পর্যন্ত নেবে টাকা দিয়ে...এমন ব্যক্তির সংগেও আমি "দেশের নৈতিকতা' শেষ হয়ে যাচ্ছে এমন আলোচনা ঘন্টার পর ঘন্টা করতে পারি। আমার জানা সবচেয়ে বাটপার সাংবাদিককেও আমি সামনে পড়লে...”ভাই আপনারাইতো জাতির বিবেক বলতে পারি।“ আমি এখন পারি।
আর যদি এতো কিছু নাও পারি...তবে একটা কাজ আমি ঠিক ঠিক করতে পারি। আমার সামনে ভুল কিছু ঘটলে ঝামেলা এড়িয়ে আমি খুব ভালো ‘চুপ করে থাকতে পারি!!’ আমার ষ্টেশন চলে এসেছে। ঝুঁকে পড়া মাথা একটু তুলে মহিলাকে খুঁজলাম। মহিলা কখন আগেই নেমে গেছে খেয়াল করিনি। বুঝলাম তার ষ্টেশন আর আমার ষ্টেশন এক ছিল না। আসলে এক হওয়ার কথাও না।